কোরবানীর ইতিহাস - কোরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার শর্ত
প্রিয় পাঠক আজকে আমরা কোরবানির ইতিহাস সম্পর্কে জানব। আপনি কি কোরবানির ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন । তাহলে আপনি ঠিক জায়গায় এসেছেন। আজকে আমি আপনাদের মাঝে কোরবানির ইতিহাস ও কোরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার শর্ত সমূহ নিয়ে আলোচনা করব।
কোরবানির ইতিহাস খুবই প্রাচীন। আমাদের সেই আদি পিতা হযরত আদম আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুগ থেকেই কোরবানির বিধান চলে আসছে। আমাদের আদি পিতা হযরত আদম আলাইহি সাল্লাম এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল এর মধ্যে প্রথম সংঘটিত হয়েছে। তাহলে চলুন কোরবানির ইতিহাস সম্পর্কে জেনে নিন।
পোস্ট সূচিপত্রঃ কোরবানীর ইতিহাস - কোরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার শর্ত সমূহ
কোরবানির ইতিহাস
কোরবানির ইতিহাস অতিপ্রাচীন। যখন আদম ও হাওয়া আঃ পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন এবং তাদের সন্তান প্রজনন ও বংশবিস্তার আরম্ভ হয় তখন হাওয়া (আ.) এর প্রতি গর্ভ থেকে জোড়ায় জোড়ায় জমজ সন্তানের জন্ম হত। এবং এর মধ্যে একটি পুত্র সন্তান এবং একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করত। কেবল একমাত্র শিস আলাইহি ওয়াসাল্লাম একা জন্মগ্রহণ করেন। আর তখন ভাইবোন ছাড়া আদম আঃ এর আর কোন সন্তান ছিল না। অথচ ভাই বোন পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না।
আর তাই এই জন্য আল্লাহ তাআলা উপস্থিত প্রয়োজন এর খাতিরে আদম আলাই সালাম এর শরীয়তের বিশেষভাবে এ নির্দেশ জারি করেন যে একই গর্ভ থেকে যে জমজপত্র ও কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করবে তারা পরস্পর সহোদর ভাই বোন হিসেবে গণ্য হবে এবং তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়া হারাম। কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী পুত্রের জন্য প্রথম গর্ব থেকে জন্মগ্রহণকারিনী কন্যা সহোদররা বোন হিসেবে গণ্য হবে না। তাদের মধ্যে পরস্পরের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ হবে।
আরো পড়ুনঃ কিসমিসের উপকারিতা - কিসমিস খাওয়ার নিয়ম ২০২৩
আর তাই সেই নিয়ম অনুযায়ী আদম আলাইহিস সালাম একটি জোড়ার মেয়ের সাথে অন্য জোড়ার ছেলের বিয়ে করিয়ে দিতেন। কিন্তু ঘটনা ক্রমে কাবিলের সাথে যে সহধররা জন্ম নিয়েছিলেন সে ছিল পরম সুন্দরী, সুবাসিনী, সুকেশিনী আর তার নাম ছিল আকলিমা। কিন্তু হাবিলের সাথে সে সহোদরা জন্ম নিয়েছিল সে দেখতে অতটা সুন্দরী ছিল না। আর তার নাম ছিল লিওযা। আর তাই ইসলামের শরিয়া অনুযায়ী হাবিলের সহোদরা কুশ্রী বোন কাবিলের ভাগে পড়ল। কিন্তু তিনি তা মানতে চাইলেন না। আর তখন হাবিল ও কাবিল এর মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে তিনি বললেন তোমরা উভয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি করো, আর যার কোরবানি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে তার সাথে আকলিমার বিয়ে দেওয়া হবে। তাহলে আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারতেছি যে কোরবানির ইতিহাস কতটা বিশাল।
সে সময় কোরবানি গৃহীত হওয়ার একটি স্পষ্ট নিদর্শন ছিল যে আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে কুরবানীকে বর্ষীভূত করে ফেলত। আর যার কোরবানি কবুল হতো না তারটা পড়ে থাকতো। তাদের কোরবানির পদ্ধতি সম্পর্কে যা জানা যায় তা হল কাবিল ছিল চাষী। আর তাই তিনি গমের শীষ থেকে ভালো ভালো মালগুলো বের করে নিয়ে বাজে মালগুলোর একটি আটি কুরবানীর জন্য পেশ করল। এদিকে কাবিল ছিল পশু পালনকারী। তাই সে তার জন্তুর মধ্যে থেকে সবচেয়ে সেরা ও সুন্দর দুম্বা কোরবানির জন্য আল্লাহর জন্য পেশ করল। আর নিয়ম অনুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে হাবিলের কুরবানীটি বর্ষীভূত করে দেয়।
এদিকে হাবিলের পেশকৃত দুম্বাটি জান্নাতে উঠিয়ে নেওয়া হয় এবং তা জান্নাতে বিচরণ করতে থাকে। আর তাই পরবর্তিতে ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওই দুম্বাটি পাঠিয়ে তার জীবন রক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু এইদিকে কাবিলের কোরবানি যথাস্থলেই পড়ে থাকলো। সুতরাং হাবিলের কোরবানিটি আল্লাহর কাছে গৃহীত হলো আর কাবিলের কোরবানিটি আল্লাহর কাছে গৃহীত হলো না। এদিকে কাবিল এই আসমানী সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারল না।
হাবিল তখন ক্রোধের জবাবে ক্রোধ প্রদর্শন না করে একটি মার্জিত ও নীতিগত বাক্য উচ্চারণ করল এতে কাবিলের প্রতি সহানুভূতি ও শুভেচ্ছা ফুটে উঠেছিল। হাবিল বলেছিলেন তিনি মুত্তাকির কর্ম গ্রহণ করেন। সুতরাং তুমি তাকওয়ার কর্মই গ্রহণ করো তুমি তাকওয়া অবলম্বন করলে তোমার কোরবানি ও গৃহীত হতো। কিন্তু তুমি তা করনি তাই তোমার কোরবানি আল্লাহর কাছে প্রত্যাখ্যান হয়েছে এতে আমার দোষ কোথায় তবু এক পর্যায়ে কাবিল হাবিল কে হত্যা করে ফেলল।
তাহলে আমরা কোরবানির ইতিহাস জানতে পারলাম এবং কোরবানির ইতিহাস ততটাই প্রাচীন যতটা প্রাচীন দিন ধর্ম অথবা মানবজাতির ইতিহাস। মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে যত শরীয়ত নাযিল হয়েছে প্রত্যেক শরীয়তের মধ্যে কোরবানি করার বিধান জারি করা ছিল। আর তাই প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতের একটি অংশ ছিল কোরবানি করা। তবে ওইসব কোরবানি কোন বর্ণনা কোন গ্রন্থে পাওয়া যায় না। তাই মূলত সেইসব কোরবানির নিয়ম কানুন আমাদেরকে জানানো হয়নি।
যাদের ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব
প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পূর্ন প্রত্যেক মুসলিম নরনারী যে ১০ জিলহজ ফরজ থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেশাপ পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার ওপরই কোরবানি করা ওয়াজিব। টাকা পয়সা সোনা রুপা অলংকার বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি ব্যবসায়িক পণ্য অপ্রয়োজনে সকল আসবাবপত্র কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।
আরো পড়ুনঃ নামাজের বিবরণ - পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ঐতিহাসিক পটভূমি
আর নেসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৯) ভরি, রুপার ক্ষেত্রে সাড়ে বাহান্ন (৫২) ভরি, আর টাকা পয়সা অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে হিসাব হলো এর মূল্য সাড়ে ৫২ তোলা রুপার মূল্য সমপরিমাণ থাকা। আর সোনা বা রুপা কিংবা টাকা পয়সা এগুলোর কোন একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজনে অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে 52 তোলা রুপার মূল্য সমপরিমাণ হয় তাহলে তার উপর কোরবানি করা ওয়াজিব। তাহলে আমরা জানলাম যাদের ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব।
কোরবানির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
কোরবানির উদ্দেশ্য অবশ্যই সৎ হতে হবে এবং তাতে ত্যাগের বহিঃপ্রকাশ অবশ্যই থাকতে হবে। কোরবানি প্রদর্শন নিজের সদিচ্ছা ও অহংকারমুক্ত হতে হবে। অনেকেই বাহবা পাওয়ার জন্যও আলোচনায় থাকার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকার গরু বা উট কিনে লাল ফিতা বেঁধে পথে পথে শোডাউন করে থাকে। তবে ইসলামের শরিয়া মোতাবেক এটা যেমন ঠিক নয় তেমনি কোন সচল ব্যক্তির জন্য জীর্ণশীর্ণ কম দামি পশু কোরবানি ও অনুচিত। কারণ এ ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর বাণীর দিকেই আমাদের ফিরে যেতে হবে।
তাহলে আমরা কোরবানির লক্ষ্য উদ্দেশ্য কি তার কিছুটা জানতে পারলাম এর সম্পর্কে আল্লাহতালা বলেন ওইসব পশুর রক্ত গোস্ত আল্লাহর কাছে কিছুই পৌঁছাবে না বরঞ্চ তোমাদের পক্ষ থেকে তোমাদের তাকওয়া তার কাছে পৌঁছাবে। অন্য একটি আয়াত থেকে প্রমাণিত যে সুস্পষ্ট, উদ্দেশ্যের সততা ও খোদাভীতি কোরবানি কবুলের প্রধান এবং মূল শর্ত। পশুটি কত বড় ও কত দামের সেটা আল্লাহর কাছে কোন বিবেচ্য বিষয় হিসেবে গণ্য হয় না। আর এই জন্য বলা হয়ে থাকে ভোগে নয় ত্যাগেই প্রকৃত সুখ এবং এই শিক্ষা অর্জন ও তার চর্চা করা ও কোরবানির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কোরবানির গোশতকে তিন ভাগে ভাগ করতে বলেছেন এবং এক ভাগ গরিবদের মাঝে বিতরণ করাকে মুস্তাহাব করেছেন ইচ্ছা হলে এর বেশি এমনকি সবটাও দান করা বৈধ।
আর তাই শুধুমাত্র পশু নয় পশুত্ব কোরবানি করা ও কোরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার সাথে আমাদের ভেতরের প্রসূদ্ধকে কোরবানি করতে হবে তাহলে ইহকাল এবং পরকালে আল্লাহর নৈকট্য পাওয়া যাবে। আমরা আস্তে আস্তে কোরবানির ইতিহাস সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পেরেছি।
কোরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার শর্ত
আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনে আত্মত্যাগের মহান ইবাদতের নাম হলো কোরবানি করা। যে কাজে হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বন্ধু হওয়ার জন্য চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সুমহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে কোরবানির বিধান আল্লাহ আমাদের উপর আরোপিত করেছেন। এ কুরবানী কোন লোক দেখানো ইবাদতের নাম নয়। আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য কোরবানি করা হয়।
আরো পড়ুনঃ নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে জানুন
কোরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার শর্ত হিসেবে প্রথমত হলঃ কোরবানির জন্য প্রয়োজন এ ক্লাস তথা একনিষ্ঠতা করা। কোরবানি হবে শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের জন্য বা উদ্দেশ্যে। নিয়তে পরিশুদ্ধতা না থাকলে কোরবানি কবুল হয় না। দুনিয়াতে প্রথম কোরবানি হাবিল ও কাবিল এর মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। আর ইতি পূর্বেই আমরা জেনেছি যে কাবিলের কোরবানি কবুল হয়নি কাবিলের কোরবানি কবুল না হওয়াযর প্রসঙ্গে হাবিল বলেছিল আল্লাহ তা'আলা মুক্তাদীদের কোরবানি কবুল করে থাকেন।
কোরবানির বিশুদ্ধ হওয়ার শর্ত হিসেবে দ্বিতীয় হলঃ আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত বিধান অনুযায়ী কোরবানি করতে হবে। এ কোরবানি সহ কোন এবাদতেই তার অংশীদার স্থাপন করা যাবে না। এজন্য আল্লাহতালা বলেন যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে। তাহলে আমরা কোরবানির ইতিহাস সমূহ জানতে পারলাম।
পরিশেষে বলা যায় যে যারা শুধুমাত্র বেশি করে গোস্ত খাওয়ার উদ্দেশ্য কোরবানি দেয় অথবা লোক সমাজের সুনাম অর্জনের উদ্দেশ্য দেখে লক্ষ লক্ষ টাকা এবং তা প্রদর্শন ও প্রচার করে থাকে তাদের কোরবানি যে ইবাদত নয় তার সবারই জানা। আর তাই আমাদের উচিত লোক দেখানো কোন কিছু করা থেকে বিরত থাকা।
নিউ বাংলা আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url