ভাষা আন্দোলন - ভাষা শহীদদের নাম ও পরিচয় জেনে নিন

 

আপনি কি ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চান? ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে জানতে হলে আপনাকে বুঝতে হবে ভাষা কি। ভাষা হল সেই বিষয় যেটা জন্মের পরে মায়ের মুখে শুনে শুনে ছোট থেকে বড় হয়ে সেই ভাষায় কথা বলতে পারা। কিন্তু তৎকালীন সময়ে এত সহজেই বাংলা ভাষার আবির্ভাব ঘটেনি, অনেক কষ্টের বিনিময়ের পরে আজকের এই বাংলা ভাষা।

ভাষা আন্দোলন - ভাষা শহীদদের নাম ও পরিচয় জেনে নিন

বাংলা ভাষার জন্য সকল শ্রেণী পেশার মানুষ মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন করেছে। আর এর ওই পরিপ্রেক্ষিতে ভাষার জন্য যে আন্দোলন করা হয় তার নামকরণ করা হয় ভাষা আন্দোলন। আর এই ভাষা আন্দোলনে অনেক শ্রেণী পেশার মানুষ আহত ও নিহত হয়।

পোস্ট সূচিপত্রঃ ভাষা আন্দোলন - ভাষা শহীদদের নাম ও পরিচয় জেনে নিন

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। আর এই আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের এক আত্মচেতনার নতুন মাত্রা যোগ করে। রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠায় রক্ত ক্ষয় তথা জীবন দান পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা বলে বিবেচিত। ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক অধিকার সচেতনতাবোধ, জাতীয়তাবাদী চেতনা পরবর্তী সব আন্দোলনে প্রেরণা যোগায়। পরবর্তী সময়ে যখন ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গন-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, এবং ১৯৭১ সালের সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের জাতীয়তাবাদী চেতনারই বহিঃপ্রকাশ।

ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব

ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের প্রথম গণচেতনার সুসংগঠিত সফল গণঅভ্যুত্থান। আর এ আন্দোলন থেকে পূর্ব বাংলার রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে নতুন ধারা প্রবাহিত হতে থাকে। পাকিস্তানের প্রতি মানুষের মোহ এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মীয় আচ্ছন্নতা কেটে যেতে থাকে খুবই দ্রুত সময়ে। এ আন্দোলন পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজকে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে। ভাষা আন্দোলনের কিছুদিন পরে ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম হয়। পরবর্তী সময়ে সকল আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছাত্রসমাজ প্রধান ভূমিকা পালন করে।

আরো পড়ুনঃ যাকাত কি - যাকাত কত প্রকার ও কি কি

ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার মানুষকে পাকিস্তানের এর শাসকগোষ্ঠীর কূটকৌশল সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিপরীতে গড়ে ওঠে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ যা মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটায়। যে কারণে মানুষ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে গ্রহণ করেনি। যার পরিণতি পাকিস্তানের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয়।

ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যই গড়ে ওঠেনি। এর সাথে বাংলার মানুষের জীবন-জীবিকার অধিকার ও জড়িত ছিল যার কারণে ভাষা আন্দোলন বেশি বেগবান হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকে পশ্চিম পাকিস্তান শাসন চক্র বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাঙ্গালীদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে থাকে এবং এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি প্রথম তাদের দাবি আদায়ের জন্য একতাবদ্ধ হয়।

এ থেকে বোঝা যায় যে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব কেমন, আর এই আন্দোলনের পথ ধরেই 1954 সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে মানুষ অগ্রসর হয়েছে যার মাধ্যমে আমরা অর্জন করতে পেরেছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম সোনার বাংলাদেশ।

ভাষা শহীদদের নাম

এখন আমরা জানবো ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারিতে যেসব ছাত্ররা মৃত্যুবরণ করেন সেইসব ভাষা শহীদদের নাম।

১. শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদ

২. শহীদ শফিউর রহমান

৩. শহীদ আবুল বরকত

৪. শহীদ আব্দুল জব্বার

৫. শহীদ আব্দুস সালাম

ভাষা আন্দোলন ভাষা শহীদদের অবদান

ভাষা শহীদগণ আমাদের জাতীয় বীর। তাদের মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাঙালি জাতীয় চেতনা জাগ্রত হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা মিছিল সহকারে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রাদেশিক পরিষদের দিকে অগ্রসর হয়। মিছিলটি যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে পৌঁছে তখন খনি নুরুল আমিন সরকারের নির্দেশে ঘাতক পুলিশ ও ইপিআর নির্বিচারে মিছিলের ওপর গুলি বর্ষণ করে ও কাদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই ছাত্র রফিক, বরকত, জব্বার ও সালাম নিহত হয়। আর এ থেকেই বোঝা যায় যে ভাষা আন্দোলন ভাষা শহীদের অবদান কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়

১৯৪৮ সালের পর যখন ২৫ ফেব্রুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করে তখন গণপরিষদে উপস্থিত সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেও ১৯৪৮ সালের একুশে মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দান বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মাঠে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন, উর্দু শুধু উর্দুই হবে একমাত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।

আরো পড়ুনঃ কলা চাষ পদ্ধতি - কলার বিভিন্ন জাত সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন

এর পরে ১৯৪৮ সালে ২৪ শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই ভাষণ দেন যে উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। জিন্নাহর এই ঘোষণায় উপস্থিত ছাত্রসমাজ না, না ধ্বনিতে উচ্চারণ করে। খাজা নাজিম উদ্দিন ১৯৫২ সালের ২৬ শে জানুয়ারি পাকিস্তান মুসলিম লীগের ঢাকা অধিবেশনে এবং পল্টন ময়দানের জনসভায় উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এর প্রতিবাদ করে ৩০ শে জানুয়ারি প্রতিবাদ দিবস পালনও করে।

৩১ শে জানুয়ারি সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট এবং ১৩ই ফেব্রুয়ারি পতাকা মিছিল পালিত হয়। এরপরে যখন ১৪৪ ধারা জারি হয় তখন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী হরতাল পালনের উদ্দেশ্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। একুশে ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা শান্তিপূর্ণভাবে শোভাযাত্রা পালন করে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি জানানোর জন্য যখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রাদেশিক আইন পরিষদ ভবনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তখন তারা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চায় স্লোগানে মিছিল বের করা হলে পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাদানিক গ্যাস নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করে।

এরপরে বিকেল তিনটার দিকে ছাত্র জনতা মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন পেরিয়ে যখন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সামনে আসে, তখন পুলিশ এই শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর গুলি চালায় পুলিশের গুলিতে ঘটনা স্থলে নিহত হন বরকত, রফিক, জব্বার ও সালাম। এ খবর শোনার পরে একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতা হত্যার প্রতিবাদে জনতার বিক্ষোভ ঢাকা শহরে উত্তল হয়। ২২ ও ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতা, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী সমাজ পূর্ণ দিবস হরতাল পালন করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শোভাযাত্রা চালায়। ভাষা শহীদদের স্মরণ করে রাখার জন্য ছাত্রসমাজ শহীদ মিনার গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিল।

এরপরে ডা. সাঈদ হায়দারের নকশায়২৩ শে ফেব্রুয়ারি তৈরি করা হলো শহীদ মিনার। ২৪ শে ফেব্রুয়ারি শহীদ শফিউরের পিতাকে দিয়ে উদ্বোধন করা হয়। ১৯৫২ সালের এপ্রিল মাসে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন প্রাদেশিক আইন সভায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। ১৯৫৬ সালে সংবিধানের মাধ্যমে উর্দু ভাষার সাথে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়।

আরো পড়ুনঃ রোজা অর্থ কি - রোজা কত প্রকার কি কি বিস্তারিত জানুন

এরপরে বাঙালির মধ্যে বাংলা ভাষার বিভিন্ন উপলক্ষ উদযাপন ও ভাষার উন্নয়নের কাজ করার মানসিকতা তৈরিতে এ আন্দোলনের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশে একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস বা শহীদ দিবস হিসেবে একই সাথে একটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। এছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসটি আরো নানাভাবে উদযাপিত হয় যার মধ্যে রয়েছে মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদযাপন যা একুশে বইমেলা নামে পরিচিত। ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগ কারীদের ত্যাগের সম্মানে এ মাসেই ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাষ্ট্রীয় বেসামরিক পদক একুশে পদক।

সর্বশেষ কথা এমন নতুন নতুন পোস্ট পেতে আমাদের ওয়েবসাইটটি নিয়মিত ভিজিট করুন এবং আমাদের সাথেই থাকুন। এছাড়াও আপনারা চাইলে আপনাদের মতামত আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারেন তাহলে আমরা আপনাদের চাহিদা মত সকল পোস্ট আপলোড করতে সক্ষম হব এতক্ষন সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

নিউ বাংলা আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url